একদা দুই মার্কিনী পথিক বিলাত ভ্রমণ করিতেছিল। ঘুরিয়া ঘুরিয়া উক্ত দেশের বহু
মনোরম আশ্চর্য্য দর্শন করিয়া তাহাদের প্রভূত আনন্দলাভ হইতেছিল। যাত্রাদরুণ এক বৈকাল
সময়ে তাহারা এক সবুজ ঘাসাচ্ছাদিত উদ্যানের পাশ দিয়া যাইতেছিল। সেই মাঠে তখন কতিপয়
বিলাতি ভদ্রলোক রাগবি খেলায় লিপ্ত হইয়াছিলেন। ইহা প্রত্যক্ষ করিয়া এক মার্কিনী
পথিক তাহার সাথীকে বলিল, “না জানি কেন ইহারা ওই কুমড়ো-সদৃশ বস্তুটিকে লইয়া এহেন
মারামারি কাড়াকাড়ি করিতেছে।” শুনিয়া তাহার সাথী উত্তর করিল, “আমি শুনিয়াছি বিলাতিগণ
‘ফুটবল’ নামক একটি খেলা লইয়া যারপরনাই মত্ত হইয়া থাকেন। বুঝি ইহারা তাহাতেই
ক্রীড়ামগ্ন হইয়া রহিয়াছে।”
খেলাটির দর্শনে পুলকিত হইয়া মার্কিনী পথিকদ্বয় সেখানেই থামিয়া পড়িল আর দীর্ঘ
নিরীক্ষণে খেলাটির নিয়মনীতি শিখিয়া ফেলিল। ইহার পর তাহারা যখন স্বদেশে ফিরিল, তখন
সেখানকার মানুষজনেদের এই বিলাতি খেলাটির কথা সবিস্তারে জানাইল। আপামর মার্কিনীরা
এই আশ্চর্য্য ‘ফুটবল’ খেলাটিকে একবাক্যে পছন্দ করিল। তবে সর্বসম্মতিক্রমে ইহার
নিয়মে কিছু রদবদল লাগু করা হইল। আঘাত যাহাতে না লাগিয়া যায় সেহেতু তাহারা খেলাটি
খেলিত বর্ম ও শিরস্ত্রাণ পরিয়া। এছাড়া কুমড়ো-সদৃশ বস্তুটিকে সামনের দিকে ক্ষেপণ
করা যাইবে না- এই নিয়মটি খেলোয়াড়ের ব্যক্তি-স্বাধীনতায় ব্যঘাত ঘটাইতেছিল বলিয়া
ইহাকে বাতিল করা হইল। শীঘ্রই মার্কিন মুলুক জুড়িয়া সকলে সোৎসাহে এই খেলায় মাতিয়া
উঠিলেন। কয়েক বৎসর পশ্চাৎ খেলাটি লইয়া তাঁহাদের আগ্রহ এমন পর্যায়ে পৌঁছাইল যে
তাঁহারা একটি জাতীয় দল গঠন করিয়া বিলাতী খেলোয়াড়দের বিপরীতে নিজেদের শক্তি পরীক্ষা
করিতে চাহিলেন।
অবশেষে বিলাতী ও মার্কিনী জাতীয় দলগুলির মধ্যে একটি খেলা আয়োজিত হইল। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর মার্কিনী দল সাড়ম্বরে বিলাত উদ্দেশ্যে রওনা হইল। সে দেশের রাষ্ট্রপতি মহাশয় দলকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানাইলেন। বহুল সংখ্যক ক্রীড়া অনুরাগী ও সাংবাদিক জাতীয় দলের সহিত এ যাত্রায় অংশগ্রহণ করিলেন, বিলাতীদের নিজভূমে পরাস্ত করিবার এ কঠিন পরীক্ষা প্রত্যক্ষ্য করিবার অভিপ্রায়ে।
ঐতিহাসিক এ সম্মুখ সমরের পূর্ব-নির্ধারিত দিনে খেলার মাঠে কাতারে কাতারে দর্শক উপস্থিত হইলেন। রুদ্ধশ্বাসে সকলে খেলা শুরু হইবার অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু অবশেষে যখন খেলোয়াড়গণ ক্রীড়াদ্বন্দ্বাভিপ্রায়ে মাঠে নামিলেন, সকলে অবাক হইয়া দেখিলেন, দুই দল বুঝি সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি খেলা খেলিতে নামিয়াছে। বিলাতী দলটি কোনোপ্রকার শিরস্ত্রাণ পরে নাই, এবং তাহারা যে বস্তুটি আনিয়াছে সেটি গোলাকার, মোটেই কুমড়ো-সদৃশ নহে। তাহাদের খেলিবার পদ্ধতিও একেবারেই ভিন্ন; বস্তুটিকে তাহারা হাতে স্পর্শ করিতে অনিচ্ছুক এবং প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে জিদান-সদৃশ মোষের গুঁতো মারিবার ক্ষেত্রেও তাহারা যারপরনাই অনাগ্রহী। এহেন অবস্থার উপস্থাপনায় মাঠ জুড়িয়া গন্ডগোল শুরু হইল।
ইতমধ্যে এক মার্কিন সাংবাদিক মার্কিন দলের প্রশিক্ষককে প্রশ্ন করিলেন, অধুনা পরিস্থিতিতে তাঁহার কি বোধ হইতেছে। মার্কিন প্রশিক্ষক ইংরাজি ভাষায় উত্তর করিলেন, “ইটস আ শকার।”
ইহাতে কোনও সন্দেহ নাহি যে প্রশিক্ষক মহাশয় ‘শকার’ বলিতে উক্ত পরিস্থিতির দ্বারা উত্থাপিত কিংকর্তব্যবিমুঢ়তার কথা-ই বলিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ মার্কিন সাংবাদিক দর্শকগণের উচ্চস্বর চিৎকারের দরুণ কথাটি বুঝিতে কিঞ্চিৎ ভুল করিলেন। তিনি ভাবিলেন, প্রশিক্ষক বলিয়াছেন, “ইটস সকার” অর্থাৎ বিলাতীগণ যে খেলাটি খেলিতে অভিপ্রেত তাহা ফুটবল আদৌ নহে, তাহার নাম ‘সকার’।
নির্ভীক সে সাংবাদিক তৎক্ষণাৎ খবরটি দপ্তরে পাঠাইয়া দিলেন, যে চতুর বিলাতীগণ ষড়যন্ত্র করিয়া মার্কিন ফুটবল দলকে ‘সকার’ নামক একটি অজানা অদ্ভুতুড়ে খেলা খেলাইবার চেষ্টা করিতেছে। তাহারা জানে যে শক্তিতে তাহাদের দল মার্কিনীদের সহিত লড়িতে অক্ষম, তাই ছল করিয়া জিতিবার এই প্রয়াস।
আপামর মার্কিন মুলুক ইহা শ্রবণ করিয়া ক্রোধে ফাটিয়া পড়িল। এহেন বিশ্বাসঘাতকতার উচিত জবাব দিবার উপলক্ষে বিলাতের বিরুদ্ধে অবিলম্বে যুদ্ধ ঘোষণা করিবার দাবি সে দেশের জনগণ বার বার করিতে লাগিলেন। শেষ অবধি যদিও কূটনৈতিক বিচক্ষণতার সৌজন্যে সে সম্ভাবনা এড়ানো যাইল। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হইয়া গিয়াছিল। কারণ তখন হইতে আজ অবধি মার্কিনীগণের মনেপ্রাণে বিশ্বাস, যে রাগবি-সদৃশ খেলাটি সমগ্র বিশ্বে কেবল তাঁহারাই খেলিয়া থাকেন তাহা আসলে ফুটবল, এবং অন্যান্য দেশের লোকেদের তাঁহারা বারংবার বলিয়া থাকেন যে বিশ্ব জুড়িয়া যে খেলাটি ফুটবল নাম পরিচিত, আসলে তাহার নাম ‘সকার’।
পরবর্তী প্রজন্ম যাহাতে এই অদ্ভুত ক্রীড়াটির আসল ও নকল নাম গুলাইয়া না ফেলে
সেহেতু মার্কিনীগণ নিজদেশেও সে খেলার প্রচলন করিলেন। আজ অব্দি তাঁহারা ফুটবল
খেলিবার সময় মনে মনে এই শপথটি গ্রহণ করিয়া থাকেন - “আমি যে খেলাটি খেলিতেছি তাহার
নাম সকার এবং আমি শপথ করিতেছি যে ইহাকে আমি আমৃত্যু সকার বলিয়াই জানিব। গোটা
বিশ্বের লোকে যাহাই বলুক না কেন তাহারা আমার এ বিশ্বাস কোনোদিন টলাইতে পারিবে না। প্রভুর নিকট প্রার্থনা করি যে অন্য দেশগুলিও যেন এ খেলাকে সকার বলিয়া জানিতে শেখে। যে দেশের লোক ইহাকে সকার বলিতে অস্বীকার করিবে আমরা তাহাদেরকে টেররিস্ট বলিয়া গণ্য
করিব এবং আকাশ হইতে বোমা মারিয়া সে দেশে ফ্রীডম ঢুকাইয়া আসিব।”
No comments:
Post a Comment